বাংলার এরদোয়ানের নাম শফিকুর রহমানঃ ইশরাক

২০১৯-২০ সালে যখন এবি পার্টি গঠিত হয় সেই একই সময়ে জামাতের ক্ষমতায় আসে শফিক।
ঐ সময়টায় জামাতের ভদ্র অংশের সামনে দুইটা অপশন ছিল- এবি পার্টিতে যাওয়া নয়ত জামাতেই থেকে যাওয়া।
এবি পার্টির নেতাদের মতে, মির্জা গালিব, শিশির মনির, নূর মোহাম্মদরা এবি পার্টিতে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে বহু মিটিং করলেও শেষ মুহুর্তে তারা জামাতেই থেকে যায়।
তবে জামাতের এই তুলনামূলক সভ্য অংশটা একেবারেই নির্লিপ্ত হিসাবে জামাতে থেকে গেছে ব্যাপারটা সেরকম না।
জামাতের ভেতর তখন একটা নীরব ক্যু ঘটায় এই তুলনামূলক সভ্য অংশটা।
জামাতে তখন শফিক বনাম খান দ্বন্দ্ব চরমে। আমির নির্বাচনে রফিকুল ইসলাম খান সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে নিজেকে আমির বানানোর।
সেসময় শফিকরা ২০০৯ সালের স্ট্র্যাটেজি ফলো করে। শফিকের পক্ষ নেওয়াকে কোরামবাজির বিরোধিতা আর খানের পক্ষ নেওয়াকে কোরামবাজির পক্ষ নেওয়া আকারে চিহ্নিত করা হয়।
নির্বাচনের আগেই দীর্ঘ সময় নিয়ে শফিক সারা দেশ সফর করে জামাতের নেতাকর্মীদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে। বিশেষ করে জামাতের নারী নেতাকর্মীদের সাথে শফিকের বন্ধন দৃঢ় ছিল।
অন্যদিকে খান দলের ভেতরে নির্বাচনী প্রচারণা ঠিকভাবে চালায় নাই এবং নারীদের সাথে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে নাই। খানের স্ট্র্যাটেজি ছিল স্রেফ নেতাদের মধ্যে গ্রুপিঙের ওপর ভর করে জিতে যাওয়া।
ঢাবি শিবিরসহ জামাতের গোটা তুলানূমলক সুশীল অংশটা এবি পার্টি এবং খান এই দুই অপশনকে রিজেক্ট করে শফিককে আমির বানায়।
শফিকের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল তার ব্র্যান্ডিংম শফিক নিজেকে সহজ সরল ও আলাভোলা আকারে উপস্থাপন করতে পেরেছে৷ ফলে সবাই শফিককে সেইফ অপশন ভেবেছে। ভেবেছে শফিক আমির হলে তারা শফিকের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খেতে পারবে।
কিন্তু আমির হয়েই শফিক দল গোছানোয় মন দেয়। খানকে অগুরুত্বপূর্ণ করে ফেলা হয়। তাহেরের এবি পার্টিতে যাওয়া প্রায় নিশ্চিত ছিল। তাহেরকে নায়েবে আমির পদ অফার করে জামাতে রেখে দেওয়া হয়।
বর্তমানে জামাত অনেকটাই শফিক নির্ভর ও শফিক কেন্দ্রিক দল। এই মুহুর্তে প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত শফিক একাই নিচ্ছে।
নির্বাহী পরিষদ এবং কর্মপরিষদ নামক যে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা জামাতকে স্থবির করে রেখেছিল সেই স্থবিরতা জামাত কাটিয়ে উঠেছে শফিকের একক নেতৃত্বে।
তবে স্বাভাবিকভাবেই শফিকের এই উত্থান সবার পছন্দ হবে না। দেখার বিষয় শফিক কিভাবে সবাইকে কো-অপ্ট করতে পারে।
আপাতত খান শফিকের জন্য কোন থ্রেট না। বরং খানের যে গ্রুপ সেটা বহুলাংশেই নিউট্রালাইজড।
সিলেটকে সামনে এনে শফিক জামাতে নিজস্ব বলয়কে স্থায়িত্ব দেওয়ার দিকে আগাচ্ছে। গোপালগঞ্জ, বগুড়ার পর সিলেট যদি বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে তাহলে জামাত একটা স্থায়ী ঠিকানা পাবে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশের মধ্যে জামাতের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা রংপুর বিভাগে। দেশের দরিদ্রতম ও সবচেয়ে বঞ্ছিত এই বিভাগ জামাতেও একই রকম উপেক্ষিত। জামাতের ক্ষমতা বলয়ে রংপুরের কেউ নাই।
জামাত চাইলে রংপুরকে ঠিকানা করতে পারত সহজেই। সিলেটকে ঠিকানা বানানোটা অনেকটাই কঠিন কারণ সিলেট সকল দলেই প্রভাবশালী।
শফিকের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তার রাজনৈতিক উত্তরসূরী নির্ধারণ। শফিকের ছেলে ইসলামপন্থী সন্ত্রাসবাদের সাথে যুক্ত মর্মে বহুল প্রচলিত। শিবিরের একাধিক নেতার মতে একারণে শফিকের ছেলেকে শিবির থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ফলে, শফিক তার ছেলেকে রাজনীতিতে আনতে পারবে না।
নেতাকেন্দ্রিক দল না হলে দল দ্রুত ভাঙ্গনের মুখে পড়ে। হাসিনা বিএনপিকে ভাঙতে পারে নাই কারণ বিএনপি জিয়া পরিবারকেন্দ্রিক দল এবং জিয়া পরিবার খুবই ছোট। খুব সম্ভবত জিয়ার এক ভাইকে কেন্দ্র করে হাসিনা একটা সময় বিএনপি ভাঙার উদ্যোগ নিলেও সেটা হালে পানি পায় নাই।
নেতৃত্বের সাথে আদর্শকে আষ্টেপৃষ্ঠে জুড়ে না দেওয়া হলে খুব সহজেই দল ভেঙ্গে ফেলা সম্ভব। শফিকের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ মওদূদী, খেলাফত, শরিয়ত ইত্যাদির নামে জামাতে ভাঙন ধরানো ঠেকানো। এটা করতে হলে শফিক এবং জামাতকে সমার্থক করে তোলার কোন বিকল্প নাই। লা জামাত ইল্লা বিল শফিক।
কিন্তু তার জন্য যে তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক বিনিয়োগ দরকার সেটা শফিক কিভাবে করে বা আদৌ করে কিনা সেটা আমাদের দেখতে হবে।
ক্যাডারভিত্তিক দল হিসাবে জামাত মৃত্যুশয্যায় আছে। জামাতের রাজনৈতিক সাফল্য জামাতের ক্যাডারভিত্তিক কাঠামোর জন্য আজরাইল হিসাবে এসেছে। বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে শফিক জামাতের ঐতিহাসিক নেতা হিসাবে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম নিশ্চিত করে ফেলবেন। শফিকের নেতৃত্বে জামাতের দলীয় কাঠামো ধ্বংস হয়ে জামাত মূলধারার জনপ্রিয়, দুর্নীতিবাজ, প্রদর্শনেচ্ছু, পদলোভী, ব্যক্তিকেন্দ্রিক দলে পরিণত হবে।
আমরা মজিবুর রহমান মঞ্জুর মধ্যে এরদোয়ানকে খুঁজছিলাম। আরবের লোকেরা যেমন বনী ইসরাইলের মধ্যে নবী খুঁজছিল। অথচ দেখা যাচ্ছে বাংলার এরদোয়ানের নাম শফিকুর রহমান।
-মোহাম্মদ ইশরাক

